সিলেটের কৃতি সন্তান সাবেক মন্ত্রী এম.এ.হক
সিলেটের কৃতি সন্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশসরকারের সাবেক ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল হকের (এম.এ.হক)। ১৮১৯ সালের ১ জানুয়ারী জকিগঞ্জের কাজলসার ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামের এক সম্ভান্ত্র মূসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী মোহাম্মদ সবজান আলী ও মাতা সকিনা খাতুন। জনগণের কাছে ‘হক সাব’ বা ‘বাঘা হক’ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলন একাধারে একজন সফল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, লেখক, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রবক্তা ও উদ্যোক্তা।
*শিক্ষা: কামালপুর পাঠশালায় তাঁর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা। ১৯৩৮ সালে সিলেট হাইস্কুলে থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪০ সালে এমসি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অর্নাস-ইংলিশ) ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্র জীবনে তিনি আসাম মুসলিম স্টুডেন্ট ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ছিলেন (১৯৪০-৪২ সাল)।
*কর্মজীবন : আসাম সরকারের পুলিশ বিভাগে ডিএসপি পদে যোগদান মাধ্যমে এম.এ হকের কর্মজীবনের সূচনা। ১৯৪৭ সালের মধ্যে আগস্টে দেশ বিভাগকালীন সময়ে তিনি কমিরগঞ্জ মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (ডিএসপি) ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি সিলেটে এডিশনাল এসপি হিসেবে যোগ দেন। এডিশনাল এসপি চট্টগ্রাম (১৯৪৯), এসপি নোয়াখালী (১৯৫০-৫১), এসপি রংপুর (১৯৫২-৫৫), এসপি ময়মনসিংহ (১৯৫৫-৫৬), এসপি ঢাকা (১৯৫৭-৫৯)। এরপর ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে এডিশন্যাল ইন্সপেক্টর অব পুলিশ (১৯৬০), ডি আইজি অব পুলিশ অব (১৯৬১) ডি আইজি অব পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ (১৯৬২-৬৪), চেয়ারম্যান সড়ক পরিহবহন সংস্থা (১৯৬৪-৬৯)।
চাকুরি জীবনে এম এ হক বিভিন্ন দেশে পেশাগত বিশেষ ট্রেনিং গ্রহণ করেছেন। যেমন বৃটিশ ইন্সটিটিউট অব পুলিশ-মালয়েশিয়া (১৯৫৫), ইন্টারপোল-প্যারিস (১৯৬৪), স্কুটল্যান্ড ইয়ার্ড-লন্ডন (১৯৬৪), ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমী ওয়াশিংটন ডিসি (১৯৬৪), পুলিশ এডমিনিস্ট্রেশন, হনলুলু (১৯৬৪), ফিলিপিনস আর্মি ইন্টেশিজেন্স (১৯৬৪) ও টোকিও পুলিশ (১৯৬৫)।
সৎ সাহসী ও কর্মনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিলো ব্যাপক। কর্মজীবন যখন যেখানে গেছেন পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে বহুমুখী আবদান রেখেছেন তিনি। নোয়াখালীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রাইমারী স্কুল, মসজিদ ও মক্তব। নোয়াখালী পুলিশ লাইন পার্ক, ফেনী পুলিশ ক্লাব। রংপুর প্রতিষ্ঠা করেন প্রইমারী স্কুল, পুলিশ লাইব্রেরী, ডেইরী ফার্ম, টাউন হল। ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করেন প্রাইমারী স্কুল ও পুলিশ কেন্টিন। ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন পুলিশ ক্লাব (১৯৫৭), রাজারবাগ পুলিশ ক্লাব (১৯৫৮), পুলিশ কো অপারেটিভ সোসাইটি (১৯৬০), সাপ্তাহিক ইংরেজী সংবাদ ম্যাগাজিন দ্য ডিটেকটিভ (১৯৬০)। পুলিশ প্রশাসেনের নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পলওয়েল প্রিন্টিং প্রেস (১৯৬২), পলওয়েল শপিং সেন্টার (১৯৬৩), জোনাকী সিনেমা হল (১৯৬২) ইত্যাদি।
সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম প্রাইভেট হাসপাতাল ‘আরোগ্য’। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করেন “দিলকুশা লায়ন্স ক্লাব” (১৯৭৪)। ১৯৭৪ সাল থেকে দীর্ঘ দিন তিনি ‘প্রবাসীর ডাক’ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। যেমন ম্যানেজিং ডাইরেক্টর-পুলিশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি (১৯৬০-৭০), সভাপতি- জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকা (১৯৬১-৭৭), সহ সভাপতি- ডায়েবেটিক সোসাইটি (১৯৬২/৮৬)।
*রাজনীতি : ১৯৭৯ সালে তিনি নির্দলীয় প্রাথী হিসেবে সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনের এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনীতির সূচনা । তিনি ১৯৮৪-৮৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কারমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (১৯৮৫-৮৬) এম এ হক ১৯৮৭ সালে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। ছেলে মোহাম্মদ রিয়াজুল হক, দুই কন্যা জনপ্রিয় সংঙ্গীত শিল্পী রেহানা আশিকুর রহমান ও আর্ন্তজাতিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফারহানা হক। তাঁর সহধর্মিনী বেগম ফাহমিদা হক হলেন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ তৎকালীন পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর বোন। ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল জনাব এম. এ. হক ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। পরদিন বনানী গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
★জকিগনজ থানা প্রতিষ্ঠাঃ ১৯৪৬ সালের ৩জুন বড়লাট লর্ড মাউন্টবেটেন (১৯০০-১৯৭৯) ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং ১৯৪৭ সালের মধ্য আগষ্টে তা কার্যকর হয়। সিলেট ও কাশ্মির অঞ্চলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, দুটি এলাকার জনগণ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে যে, তারা পাকিস্তানভূক্ত হবে, নাকি ভারতভূক্ত হবে।১৯৪৭ সালে ৬ ও ৭ জুলাই (সোম ও মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত গণভোট সিলেটবাসী পাকিস্তানভূক্ত হবার কথা। আসাম সরকার এম. এ. হককে করিমগঞ্জ মহকুমা পুলিশ অফিসার করে পাঠায়। করিমগঞ্জ পৌঁছে হকসাব ১৪ আগষ্ট মহাধুমধামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উৎসব পালন করেন। ১৭ আগষ্ট সন্ধ্যায় রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হলো রেডক্লীফ রোয়েদাদ (বাঁটোয়ারার বিবরণ) অনুযায়ী করিমগঞ্জ শহরসহ দক্ষিণপূর্ব অর্ধেক এলাকা (সাড়ে তিন থানা) ভারতভূক্ত হবে। ষড়যন্ত্রমূলক ও ঘোষণায় নিমিষেই পাল্টে গেলো করিমগঞ্জের অবস্থা। এর প্রতিবাদে মুসলমানগণ রাস্তায় নেমে আসে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আশংকা প্রকট হয়ে উঠলো। ডিএসপি এম এ হক কংগ্রেস নেতা কামিনী কুরাম সেন, রবীন্দ্র আদিত্য এবং মহকুমা মুসলিমলীগ সেক্রেটারী এডভোকেট্ শামছউদ্দীন আহমদ চৌধুরীকে (গণিপুর নিবাসী) সাথে নিয়ে শান্তি শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
১৯ আগষ্ট ১৯৪৭ যৌথ স্টিয়ারিং কমিটি থেকে বার্তা পাঠানো হলো- আসাম সরকার ডিএসপি আব্দুল হককে পাকিস্তানে চলে যেতে ছেড়ে দিয়েছে। অবিলম্বে তাঁকে সিলেট গিয়ে রির্পোট করতে হবে। কমিটির এ সিদ্ধান্তে এম এ হক দেখলেন তাঁর প্রিয় পাকিস্তান অংশের হেডকোয়ার্টার শেওয়াল স্থাপন করতে হবে। কমিটির এ সিদ্ধান্তে এম এ হক দেখলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি জকিগঞ্জ বঞ্চিত হতে যাচ্ছে। এছাড়া পাকিস্থানভূক্ত বিয়ানীবাজার থানার অন্তর্গত শেওলার চেয়ে হেডকোয়ার্টার করিমগঞ্জের পার্শ্ববর্তী গ্রাম্য হাট জকিগঞ্জে প্রতিষ্ঠাই আধিক যুক্তিযুক্ত।
২৬ আগষ্ট সিলেটের ডিসি এ এসপিকে জানিনে দিলেন, আপাতত শেওলার পরিবর্তে তিনি জকিগঞ্জ থানা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছেন। জবাবের অপেক্ষা না করেই ২৭ আগষ্ট তিনি স্বহস্তে করিমগঞ্জ থানার রাইফেল, চেয়ার টেবিল, রেকর্ডপত্রসহ সবকিছু দুইভাগ করে একভাগ নৌকায় তুলে জকিগঞ্জ পাড়ি জমান। স্থানীয় কাচারী ঘরে পাকিস্থানের পতাকা উত্তোলন পূর্বক ‘ জকিগনজ থানা’ প্রতিষ্টা করেন। বিচক্ষণ এ পুলিশ অফিসার স্থানীয় রাজনীতিবিদগণের সহায়তায় জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি স্থাপন করে স্মরণীয় হয়ে রইলেন।
২। জকিগনজ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকাঃ ১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারী গঙ্গাজল নিবাসী রেডিও ইঞ্জিনিয়ার জনাব কুতুব উদ্দিনকে প্রধান শিক্ষক করে বেসরকারী ভাবে যাত্রা শুরু হয় জকিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের। এ বছরই পুলিশ কর্মকর্তা এম এ হকের প্রচেষ্টায় তৎকালীন ভিপিআই ড. কুদরত-ই-খুদা জকিগঞ্জ এসে বিদ্যালয়টি ভিজিট করে যান। অল্পদিনের এ বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
৩। জকিগনজ কলেজ প্রতিষ্ঠাঃ ১৯৮৪ সালে এম এ হক জকিগঞ্জের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন জকিগনজ কলেজ। পূর্ণ সরকারী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর নিয়মিত অনুদানে কলেজ পরিচালিত হয়।
৪। ইছামতি মাদরাসার সরকারী মঞ্জুরী প্রাপ্তিতে ভূমিকাঃ ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এম এ হক এবং তাঁর ভাই শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের প্রচেষ্টায় ইছমতি দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসা একই সাথে দাখিল ফাযিল পর্যন্ত সরকারী মঞ্জুরী লাভ করে।
১৯৭৮ সালে ভারত সরকার জকিগঞ্জ বাজারের পূর্ব দিক বরাবর কুশিয়ারা নদীতে গ্রোয়েন নির্মাণ শুরু করে। দরদী নেতা এম এ হক ভারতীয় সে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন। জকিগঞ্জবাসীকে সাথে নিয়ে তিনি দুর্বার আন্দোরন গড়ে তুলেন। এম এ হকের অভ্যাহত চাপের মুখে তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি হরে। ফলে ভারত সরকার গ্রোয়েন নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে। উল্লেখ্য যে, ১০ কোটি রুপে ব্যয়ে এই গ্রোয়েন বাস্তবায়িত হলে জকিগঞ্জ বাজার সহ পার্শবর্তী এলাকা কুশিয়ারা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যেতো।
এ ছাড়া জনাব এম এ হকের প্রচেষ্টায় জকিগঞ্জ মহকুমা শিক্ষা অফিস, মহকুমা আনসার অফিস, পানি উন্নয়নে দিক নির্দেশনামূলক অনেক কাজ হয় ।
★প্রকাশিত গ্রন্থঃ
*১. রাহুগ্রস্থ বাংলাদেশ-রাহুমুক্তির রূপরেখা
প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ১৯৯০
*২. সৃষ্টির সেরা শত মানুষ
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ১৯৮৯ (প্রথম সংস্করণ) ফেব্রুয়ারী ২০০২ (দ্বিতীয় সংস্করণ)
প্রকাশক: রুনা প্রকাশনী, ঢাকা।
*৩. দারিদ্র বিমোচন
প্রকাশ : এপ্রিল ১৯৯৯
প্রকাশক: এম এ হক ফাউণ্ডেশন, ঢাকা।
*৪. Fate Of Democracy In Bangladesh
প্রকাশ : এপ্রিল ২০০০। প্রকাশক : এম এ হক ফাউণ্ডেশন, ঢাকা।
*৫. দেশটা কি রসালতে যাবে। প্রকাশকাল : ১৯৮৫
*৬. Yahye’s Master Plan
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫। প্রকাশক : রুনা প্রকাশনী, ঢাকা। তথ্যসূত্র; ইন্টারনেট