প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন
“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
[তাহারেই পড়ে মনে]
কবি বেগম সুফিয়া কামাল বসন্তের আবেদনকে
এভাবেই তুলে ধরেছেন।
জবুথবু মাঘের আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন থেকে জীর্ণতা সরিয়ে প্রকৃতির ফুলে ফুলে সেজে ওঠার দিন এই বসন্ত।
বসন্ত মানে নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই মৃদু হাওয়ায় মনকে সাজায় বাসন্তী রঙে, মানুষকে করে জীর্ণতা সরিয়ে নতুন শুরুর প্রেরণা।
প্রিয় কবি আল মাহমুদের উক্তি-
‘হঠাৎ শীতের শেষে ফাল্গুনের ফুটন্ত আকাশ
সাহসী দৈত্যের মতো অভাবিত মেঘের আসর
জমলো এমনভাবে, ভাবলাম, বঙ্গোপসাগর
উদ্বৃত্ত জলের কণা পাঠিয়েছে আগেই এ মাসে।’
ফালগুনের সবুজ বুকে লেগেছে বহুবর্ণের ছাট। বইছে প্রাণ উতলা করা দক্ষিণা হাওয়া। ঋতুরাজের আগমনী বার্তা জানিয়ে ফুটেছে পলাশ। টিয়া-মৌটুসির খুনসুটি বলে দেয়, এসেছে ফালগুন। বসন্তে ফুটেছে শিমুল। শীতে ঝরে পড়েছে পাতা। ন্যাড়া গাছের রিক্ততা দূর করে রক্তরাঙা শিমুল কুঁড়ি এসেছে ফালগুনে। পাখির ঝাঁকও যেন মুগ্ধ এই সৌন্দর্যে!
বসন্ত কচিপাতায় আনে নতুন রঙ, আলোর নাচন। তাই তো সবুজ পত্রপল্লবের আবডালে লুকিয়ে বসন্তের দূত কোকিল শোনায় কুহুকুহু ডাক।
ফালগুন- চৈত্র-এ দুমাস বসন্তকাল। বসন্তকালে প্রকৃতিতে দেখা দেয় নতুন চঞ্চলতা, নতুন সাজ। গাছে গাছে নতুন পাতার সমাহার; বাগানে দেখা যায়, কুঁড়ি ও ফুলের সমারোহ। শোনা যায়, ভ্রমর ও মৌমাছির গুনগুন সুর। কোকিলের সুমিষ্ট কণ্ঠে বাজতে থাকে কুহুকুহু তান, যা শুনে মুগ্ধ হয় মানুষ। দখিনা বাতাস মানুষের শরীর-মন করে স্নিগ্ধ ও শীতল। বসন্তকালে যেদিকে চোখ যায়- শুধু সজীবতা ও সৌন্দর্যের আলপনা চোখে পড়ে।
প্রকৃতির অপূর্ব উপহার স্নিগ্ধ, সতেজ ও প্রাণময় বসন্তের ছোঁয়া থেকে বাদ যায় না গ্রাম্যজীবনও। আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে গ্রামেও বসন্তের আমেজ বিরাজ করে। বসন্ত শুধু প্রকৃতি আর মানবমনেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে জীবনকে স্নিগ্ধ, সতেজ ও প্রাণময় করে তোলে!
প্রকৃতিবিদ মোকাররম হোসেন বলেন-
‘অনেক ফুল, পাতা, পাখির কুজন সবকিছু মিলিয়ে বসন্ত নতুন উন্মাদনা নিয়ে আসে আমাদের মাঝে।’
বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্ত রঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপরও রং ছড়ায়।
১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
বসন্তের সার্থকতা কোথায়?
কবি নির্মলেন্দু গুণের বসন্ত ভাবনায় সে
কথাই ফুটে ওঠে –
এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে
মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মরে
পাতা ঝরা , স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা চাদ, জ্যোৎস্নাময়
রাতের উল্লাসে কালো বিষ। এ না হলে বসন্ত কিসের?
[“আমার বসন্ত”]
ঋতুচক্রের ক্রমধারায় এই বাংলাদেশে বসন্ত আসে নব নব প্রাচুর্যে প্রকৃতিকে ফুলে ফলে সম্পদে-ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধিশালী করতে। কুহেলী মাঘের শীতের বিষন্নতা তিরোহিত করে প্রকৃতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করতে ঋতুরাজ বসন্তের আবির্ভাব ঘটে এই বঙ্গদেশে। ফাল্গুন প্রকৃতির বহুবর্ণিল বৈচিত্র্যের সমারোহে বাংলার রূপ লাবণ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তর্লোকের প্রগাঢ় অনুভূতি ও ভাবব্যঞ্জনা নতুনত্বে ভাস্বর হয়ে ওঠে।
প্রকৃৃতির এ আবহ কোন অবস্থাতে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। প্রকৃতির পালাবদলে যে ঐশ্বর্য বিরাজমান, যে চিরায়ত নবরূপে সেজে প্রকৃতি আজ সমৃদ্ধ হবে, সেই চিরন্তন সত্য থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীটাকে সুন্দর, প্রাণময় আর নিষ্কলুষ রাখার দীক্ষা নিতে হবে।
আসমান ও জমিনের এতসব সৌন্দর্য, অলৌকিকত্ব, মানুষের অন্তঃকরণের রঙিন চোখের পর্দায় অবশ্যই ধরা পড়ার কথা।যদি সে অন্ধ না হয়। মানুষ তার বোধ শক্তি, মেধাকে কাজে না লাগালে, এ নিয়ে চিন্তা বা গবেষণা না করলে, মহান শিল্পীর সৃষ্টিকে বাইরের চোখ ও মনের চোখ কোনো চোখেই বড় করে দেখা যাবেনা। স্রষ্টার অস্তিত্বের কোটি কোটি প্রমাণ তার কাছে শূন্য বলে বিবেচিত হবে!
শেষ করতে চাই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সেই
ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে। ইরশাদ হচ্ছে –
“দয়াময় স্রষ্টার সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখতে পাবে না, তোমার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দেখো, কোনো ত্রুটি দেখ কি? আবার দেখ, আবারো! তোমার দৃষ্টি তোমারই দিকে ফিরে আসবে ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে।” [সূরা মুলক : ৩,৪]
লেখকঃ প্রাবন্ধিক