রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ || কালজয়ী গানের ইতিহাস

‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ’…। চাঁদ উঠেছে। শাওয়ালের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি মুমিন মুসলমানের ঘরে আনন্দের ঢল নামে। সাম্য-মৈত্রী-শান্তি আর মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় ঈদুল ফিতর। এদিন হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যায় মানুষ। তাদের ভেতর কোনো আমিত্ব থাকে না। ধর্মীয় মূল্যবোধে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলিত করে। মানবিকতা জাগ্রত করে।
পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল, বিশেষ করে বাংলাদেশে ঈদের একটি গান অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঈদের আগের রাত থেকে টেলিভিশন, রেডিও থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের দোকান, মার্কেট সর্বত্র বাজতে শুরু করে, “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন। গানের গভীরে কী বলতে চেয়েছেন কবি তাঁর মাত্র দশ লাইনের গানে!
★আব্বাসউদ্দিনের নিজ জবানিতে আমি ও কাজীদা;
*একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল-এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না? আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের-কুফর বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙেক্তয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! যদি ইসলামি গান লেখেন, মুসলমানের ঘরে ঘরে উঠবে আপনার জয়গান।’
তিনি বললেন, ‘আব্বাস, ভগবতীবাবুকে বলে তার মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না।’ ভগবতী ভট্টাচার্য, অর্থাত্ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না।
ছয় মাস পর। দুপুরে বৃষ্টি, অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল ঘরে গিয়েছি। দেখি, বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী ও বৃদ্ধ ভগবতীবাবু রসালো গল্প করছেন। সালাম দিতেই বৃদ্ধ বললেন: ‘বসুন, বসুন।’ বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, বিক্রি না হলে আর নেবেন না, ক্ষতি কি?’ হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’
পাশের ঘরে কাজীদা। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। তখনই সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন: ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’।
গান দুখানা লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড। কাজীদার ধৈর্য মানছিল না, চোখেমুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল! তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দুখানা তখনো মুখস্থ হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই আমার প্রথম ইসলামি রেকর্ড। দু’মাস পর ঈদুল ফিতর। শুনলাম, গান দুখানা তখন বাজারে বের হবে।
ঈদের বাজার করতে ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বি এন সেন, অর্থাত্ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিদার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, আমার দোকানে এস।’ এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বসলেন, ‘এর ফটোটা নিন।’ আমি অবাক! বললাম, ‘ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস, আবার কী?’
ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম। কলকাতায় ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছি। ট্রামে একটি যুবক পাশে গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। অবাক হলাম। এ গান কী করে শুনল! অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। বিভূতিদার দোকানে গেলাম। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। সন্দেশ, রসগোল্লা, চা এনে বললেন, ‘খাও।’ গান দুটো এবং আর্ট পেপারে ছাপানো বিরাট ছবির একটা বান্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘বন্ধুবান্ধবের কাছে বিলি করে দিও। সত্তর-আশি হাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখ, দু’হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার।’
আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠল। ছুটলাম কাজীদার বাড়ি। তিনি রিহার্সাল রুমে। দাবা খেলায় মত্ত। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে-’ আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তার কদমবুসি করলাম।
তথ্যসূত্র: আমার শিল্পী জীবনের কথার ১৩৩ নম্বর পৃষ্ঠা,আব্বাসউদ্দীন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ