২০১৯ সালে দেশে ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ

গত পাঁচ বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ৮৭৯টি, যা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ এক হাজার ৬০৭টি।

নারীর অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করা নেত্রীরা বলছেন, পুরোনো আইনে ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ও এজন্য দায়ী। এছাড়া যৌনবিষয়ক শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব; আকাশ-সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী বিস্তার, প্রযুক্তির অপব্যবহারে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। ঘটনায় সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের জন্য দ্রুত বিচার আইনে বিচারের দাবি তাদের।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে ধর্ষণ-গণধর্ষণের ঘটনা আট হাজার ৭৮টি। ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬২৬টি। ২০১৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ৮৭৯টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে এবং ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ১২৮টি। কিন্তু ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণ-গণধর্ষণ হয়েছে এক হাজার ৬০৭টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে। ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ২৫৪টি। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়ে লোকলজ্জায় আত্মাহত্যা করেছেন ১৯ নারী।

অপরদিকে, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এক হাজারের বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে ধর্ষণের শিকার ৮৪ শিশু।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ধর্ষণের ঘটনার পরিসংখ্যান প্রতি বছর বাড়ছে। যে হারে নারী নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে তাতে আমরা শঙ্কিত। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। নারী নির্যাতনের বিচার দ্রুত বিচার আইনে করা গেলে এর আইনগত প্রতিকার কিছুটা হলেও মিলবে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, অতীতে ধর্ষণকারীকে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে দেখা গেছে। এসব বন্ধ করতে হবে।

সংস্থাটির আইনি সহায়তাকারী অ্যাডভোকেট মাকসুদা আক্তার লাইলী বলেন, আইন বলে যে, ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হতে হবে; কিন্তু বাস্তবে বিচার পেতে সময় লাগে আট থেকে ১০ বছর, কখনও ১৫ বছরও লেগে যায়। নতুন নতুন মামলার শুনানিতে প্রতীয়মান হয় যে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পৃথক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। ২০১৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৭৩২টি এবং ২০১৭ সালে ৮১৮টি।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ধর্ষণের ঘটনা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ঘটছে। সম্প্রতি ঢাবির ছাত্রী ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের জন্য লজ্জার। সামনের দিনগুলোতে নারীর ওপর নির্যাতনের বিচার যদি না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আমার ওপরে নির্যাতন হবে কিংবা আপনার পরিবারের কোনো নারীর ওপর নির্যাতন হবে কিন্তু বিচার হবে না। দেশের যে সামাজিক বলয় তাতে বিচারহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ (এমজেএফ)- এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের বছর (২০১৮ সাল) ছিল ৩৫৬ জন। ২০১৯ সালে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৩ শিশু। ধর্ষণের শিকার ৪৮ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর এবং ৩৯ শতাংশের বয়স সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

অন্যদিকে পুলিশ সদরদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে এক হাজার ৯২৪টি। এর মধ্যে ৫১.৬২ শতাংশই ধর্ষণের অভিযোগে মামলা। এক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্তির হার মাত্র ১১.২৬ শতাংশ।

পুলিশ সদরদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি- মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার তদন্ত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। গত বছর নির্ধারিত সময়ে এ সংক্রান্ত ৮৪ শতাংশ মামলার চার্জশিট দিয়েছি।

তিনি বলেন, দু-একটি ঘটনায় বিচ্যুতি থাকতে পারে। তবে সেটা পুলিশ জানামাত্র কিংবা অভিযোগ পাওয়ামাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটামাত্র জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’- এ জনানো মাত্র পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড. সানজিদা আখতার বলেন, নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনার পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটে আসছে। প্রথমত, বিচারহীনতার কারণে জনসম্মুখে বলার কিংবা দৃষ্টান্তস্থাপনের মতো কিছুই হচ্ছে না। এই যে বিচারহীনতা কিংবা আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাওয়া, এটা একটা বড় কারণ। আইনের ভয়ও তাদের (অপরাধী) কাজ করে না।

‘দ্বিতীয়ত, ধর্ষণটা ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা সমাজের অনেক জায়গায়ই নেই। ধর্ষণ যে একটা নৃশংস ও জঘন্য অপরাধ সে সম্পর্কেও সমাজে বিশেষ প্রচারণা নেই। আমরা শিক্ষার কারিকুলামে কিংবা কালচারালিও বিষয়টি ধারণ করতে পারিনি। পারিনি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতেও।’

তৃতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গোটা সমাজব্যবস্থা হতাশাগ্রস্ত। সামাজিক মোরালিটিতেও ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয় বেড়েছে। নারীর পদচারণা বাড়লেও তাদের অগ্রগতি কিংবা নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত সেভাবে আমাদের সমাজব্যবস্থাকে গড়ে তোলা যায়নি। নারীকে ঘরে কিংবা বাইরে মানুষ হিসেবে দেখার মতো মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়নি। ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করব- সেটাও এখন কমপ্লেক্স (জটিল) হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমাদের মধ্যে পরিবর্তন না আসলে অবস্থা আরও আশঙ্কাজনক হবে। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে আগে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ