স্বাধীনতার মাস
মহান স্বাধীনতার মাস, সংগ্রামী চেতনায় ভাস্বর ঐতিহাসিক মার্চের সূচনা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ন্যায়সঙ্গত ও প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। এ ভূখন্ড তখন ছিল আন্দোলনমুখর, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। বিরামহীন নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর জনগণ বাংলাদেশ নামক একটি দেশের মানচিত্র বিশ্বের মাঝে খুঁজে পায়। দুর্বিনীত সাহসিকতার সাথে লড়াইয়ে পরাজিত করে হানাদার বাহিনীকে। ভৌগোলিক সীমারেখার সাথে সাথে নিজের করে পায় একটি লাল-সবুজের পতাকা।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের পাঁচটি প্রাদেশিক পরিষদ এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচন একযোগে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দাবিতে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নির্বাচন বর্জন করে। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ বিজয় অর্জন করে। প্রদেশের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ৮৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় প্রধান দল হিসেবে স্বীকৃত পায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পর ২০ ডিসেম্বর ভুট্টো জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের আসনে বসতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে পরিস্থিতি ঘনীভূত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর মহল এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনে ভুট্টো ক্রমেই পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন। শোষিত-নিষিত ও অধিকারহারা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের হাতে ক্ষমতা দেয়া হবে না এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময় মওলানা ভাসানীসহ প্রদেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জোরালো সমর্থন জানান। আওয়ামী লীগের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। এ সময় ভুট্টো পরিষদে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং পরিষদকে কসাইখানা বানানো হবে বলে হুমকি দেন। সেই সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান প্রণয়নকালে পিপিপিসহ পশ্চিম পাকিস্তানী দলগুলোর বক্তব্য ও পরামর্শ বিবেচনা করার আশ্বাস দেন। এদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে একাত্তরের পহেলা মার্চ এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনকে অনির্দিষ্টকাল স্থগিত ঘোষণা করেন। জেনারেল ইয়াহিয়ার এ ঘোষণায় গোটা প্রদেশের ধর্ম-বর্ণ-পেশা-বয়স নির্বিশেষে জনগণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ সময় মার্চের শুরুতেই শেখ মুজিব ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল আহবান করেন।
ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগ পরিষদীয় দলের সভা চলাকাল বাইরে সমবেত হাজার হাজার মানুষ অতিদ্রুত সার্বভৌম জাতীয় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি দাবি জানাতে থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে ফেলে। ছাত্র নেতারা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগাম পরিষদ নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এর নেতা নূর-ই আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে যৌথ নেতৃত্ব প্রদানের ঘোষণা দেন। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণাটি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই প্রথম রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।”