তরুণ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রযুক্তি
একটি দেশে তরুণদের নিয়েই যুবসমাজ। নারীরাও সমাজের সামগ্রিক অংশগ্রহণে বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। উত্তরাধুনিক সময়ের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আজ জীবনের সংজ্ঞা পাল্টেছে। এখন তরুণের বয়স আঠারো থেকে ত্রিশে নির্ধারণ হয়েছে। আঠারোতে তারা শিশু, ত্রিশে তরুণ। ত্রিশেই তারা পরিপূর্ণতা লাভ করে। আঠারো থেকে শুরু করে ত্রিশ পর্যন্ত তারা তরুণ। তারপর শুরু হয় নারিত্বের পরিপূর্ণতা। কুড়িতে বুড়ি সে বাণী আজ মিছে। পঞ্চাশে তারা কুড়ি মেলতে শুরু করে। ষাটে তাদের পরিপূর্ণতা। মানুষের গড় আয়ুষ্কাল এখন ঊর্ধ্বমুখী। জীবনযাত্রার মান বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল রেখে উদ্দাম গতিতে ছুটছে। তাই তরুণ ও নারী আজ পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক পরিব্যাপ্ততায় গভীরভাবে নিজেদের পরিব্যাপ্ত করছে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনসমষ্টি এই তরুণসমাজ। কারণ শিশু, কিশোর বা পৌঢ় বৃদ্ধাদের দিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ হয় না। দেশের মুক্তি ও উন্নতির জন্য তরুণ বা যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হয়। ইতিহাস তার সাক্ষ্য। এই তরুণরাই জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে নব জীবনের গান শুনিয়েছে। সূর্যকে রেখেছে হাতের মুঠোয়। অনাগত দিনের স্বপ্নকে দিয়েছে বাস্তবতার রূপ। স্বপ্নহীনদের স্বপ্ন দেখিয়েছে, আশাহতদের নতুন দিনের প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত করেছে। শক্তিহীনকে শক্তি দিয়েছে। সেই শক্তি মানুষের জীবনকে করে গতিশীল, প্রত্যাশাস্নিগ্ধ ও স্বপ্নময়। এই তরুণরাই অটল সাধনার প্রতীক হয়ে এই রুগ্ণ, ক্লান্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে ক্লান্তিহীন, উদ্যম, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণ চাঞ্চল্য ও অটল সাধনার প্রতীক হয়ে জাতির ক্লান্তিকালে ঝাণ্ডা বহন করে নতুন সূর্যের আগমনী গান শোনায়। আর নারী তাদের সঙ্গে থাকে, পাশে থাকে, হৃদয়ে থাকে ক্লান্তিহীন। কবির ভাষায় ‘রাজা করিছে রাজ্য শাসন, রাজাকে শাসিছে নারী’।
সময় বদলেছে। আজ সরাসরি নারী করিছে রাজ্য শাসন আর নারীকে শাসিছে নারী। পুরুষ সেখানে গৌণ। মাঝে মাঝে তারা উদিত হন আলোকবর্তিকা হাতে। তাই আজও পৃথিবী এত সুন্দর! আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। বিএনপি চেয়ারপারসন নারী। নারী স্পিকার, নারী ভিসি, নারী ডিসি, নারী শিক্ষক, নারী ভিপি, নারী ডাক্তার, নারী এসপি, নারী পাইলট, নারী উদ্ভাবক, নারী গবেষক, নারী লেখক, নারী সমাজ বদলের হাতিয়ার। নারী মা। নারী বোন। নারী প্রেমিকা, নারী জাতিকা, নারী কন্যা, নারী মায়াবী পরশে হীরা পান্না। এই নারীই আবার প্রয়োজনে ফুলন দেবীর ভূমিকায় গর্জে ওঠেন অহর্নিশ। দুর্নীতি দমনে নারী সিদ্ধহস্ত, ন্যায়-বিচারে নারী পারঙ্গম। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর সাফল্য ঈর্ষণীয়। সংসার পরিচালনায় নারী পরিপক্ব। সন্তান ধারণ, জন্মদান, লালনপালনে নারী একক ভূমিকা পালন করছে সৃষ্টির শুরু থেকে। নারী মানব এবং একই সঙ্গে নারী মানবী। তাই এই সমাজ পরিচালনায় তরুণের মতো নারীরও রয়েছে যথাযথ ভূমিকা। দেশের যেকোনো সংকটকালে, মুক্তিসংগ্রামে, দেশ পরিচালনা এবং তাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে নারী তরুণের, পুরুষের পাশে থাকে ওতপ্রোত।
আমাদের আজকের স্যাটেলাইট যুগে তরুণ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন আবিষ্কার ও উৎপাদনে রূপ দেওয়া হয় তাকে বলে প্রযুক্তিবিদ্যা। বিজ্ঞান যখন মানুষের প্রয়োজনের সীমায় বাঁধা পড়ে, তখন প্রযুক্তিবিদ্যার জন্ম হয়। আর তথ্যপ্রযুক্তি হলো কম্পিউটার বা টেলিযোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে তথ্য সংরক্ষণ, গ্রহণ, প্রেরণ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি কাজের জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির উদ্দেশ্য তথ্যের সরবরাহ সুনিশ্চিতকরণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনযাত্রাকে সহজসাধ্য করা। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যতিরেকে আধুনিক সভ্যতার কথা চিন্তা করা যায় না।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জীবনমানের অগ্রগতির মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতা। সভ্যতার অগ্রযাত্রার পেছনে কাজ করছে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচিত্র আবিষ্কার এবং সেগুলো মানবকল্যাণে ব্যবহারের বিভিন্ন প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন এনে দিয়েছে। ফলে মানুষ উন্নত চিন্তা ও চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে নব নব আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীকে নতুনভাবে সাজানোর কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কয়েকটি দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহসহ ছাদবাগান কৃষিতে মেয়েরা এখন এগিয়ে, যা সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। আমরা প্রতিনিয়ত শাইখ সিরাজের গ্রন্থনা ও পরিচালনায় পরিবেশিত অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ তা দেখতে পাই। আমরাও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলে একই সঙ্গে পুষ্টি এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারব। শিশু ও মায়ের মৃত্যুরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ-সংক্রান্ত তথ্যাদি পরিবেশন করা। মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতামত ও পরামর্শ সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা। বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধনে সহায়তা করা। লেখক, গবেষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সামাজিককর্মীরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের কৃতিত্ব ও সাফল্যম-িত করতে পারে। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক সূচক নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা। দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উন্নয়নের অন্তরায়কে তুলে ধরা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম তথ্য সরবরাহ ও পরিবেশন করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অগ্রগতির মূল বিষয় সম্পর্কে উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নকর্মীদের সচেতন ও সহায়তা করা। মানুষকে কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করা।
আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রেরণা জাগানো। শিক্ষা বিস্তার, মানবীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং সহিষ্ণুতা বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতন ও সহায়তাদান করা। মানুষকে কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করা। আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগানো। অতীত ঐতীহ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য পরিবেশন করে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ। তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ অত্যন্ত সহজেই করতে পারি। বর্তমান সময়ে ফেসবুক, ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহারের ফলে সামাজিক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। ঘরে বসেই পৃথিবীর অপর প্রান্তের আনাচে-কানাচে কী ঘটে যাচ্ছে, তা আমরা মুহূর্তেই জানতে পারছি। দেখতে পারছি। কিন্তু কতটুকু আমাদের জানা প্রয়োজন? কতটুকু আমাদের দেখা প্রয়োজন? কতটুকু সময় আমরা এই যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যবহার করব, সেটাও এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। যদি দিনের কর্মঘণ্টার অধিকাংশ সময় আমরা ফেসবুকে ব্যবহার করি, তো আমাদের সৃজনশীলতার জন্য ধ্যানস্থ হতে ব্যাঘাত ঘটায়। সময়ের স্বল্পতার কারণে আমরা আমাদের জরুরি কাজগুলোকে ততখানি গুরুত্ব দিতে পারি না, যতখানি সেই কাজটি আশা করে।
অনেক উঠতি বয়সি মানুষ এমনকি মধ্য এবং পৌঢ় এক কথায় সব বয়সের মানুষ আজ এতটাই এতে যুক্ত হয়ে পড়েছেন যে, আমি শঙ্কিত। রাত জেগে তারা সামাজিক যোগাযোগে চ্যাট করে অযথা ঘুমের সময় নষ্ট করে স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছেন। আগামীর বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে হুমকির মুখে পড়বে বলে আমি দ্বিধাগ্রস্ত। এই ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়ের প্রয়াসে আজ পরপ্রেম, অসমপ্রেম সমাজ সংসারকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আমরা এখন তরুণের বয়সের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলেছি। পাল্টে ফেলেছি নারীর বয়সের সংজ্ঞা। এখন আঠারো থেকে ত্রিশ বছরকে তরুণ বলে অভিহিত করছি এবং কুড়িতেই নারীরা বুড়ি সে কথা পেছনে ফেলে নারীদের ষাটে এসে পরিস্ফুটিত হতে দেখছি। তাই এই ব্যাপক এবং বিশাল সমাজ ও সময়ের তরুণ এবং নারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা যদি অকার্যকর সময়ে বিনষ্ট না করে পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তবে আগামীর বাংলাদেশ হবে মাধুর্যমণ্ডিত ও উন্নয়নশীল।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর
shahnaj.parvin2009@gmail.com