করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ মোট ২৫ দেশ কভিড-১৯-এর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ২৪টি দেশ হলো : আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাজিকিস্তান, ফিলিপাইন, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, কিরঘিজ প্রজাতন্ত্র, লাওস, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।

একইভাবে বাংলাদেশের চারপাশে প্রতিবেশী দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ায় রোগটিকে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলছে চীনও। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, যেকোনো স্থান থেকেই করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশেও করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সে কারণে বাংলাদেশও ঝুঁকিতে রয়েছে এবং বাংলাদেশের উচিত সতর্ক থাকা। তাই পরশু, কাল বা আজ নয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সব বন্দরে (নৌ, স্থল, বিমান) থার্মাল স্ক্যানার বসানো জরুরি।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এমন ‘উচ্চ ঝুঁকি’ ও ‘ঝুঁকির’ সতর্কতা মেনে নিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তবে কেবল বাংলাদেশ বিবেচনায় এ ঝুঁকি নয় বলে মন্তব্য করেছেন আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, শুধু বাংলাদেশ হিসেবে এ ঝুঁকি নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগে শুধু চীনের জন্য ‘ভেরি হাই অ্যালার্ট’ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু রোগটি চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ায় এখন বিশ্ব করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি বা সন্দেহজনক কেউ নেই। তবে দেশের চারপাশে ও যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে, যাত্রীদের আসা-যাওয়া রয়েছে, সেসব দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরে সংস্থাটি ‘ভেরি হাই অ্যালার্ট’ ঘোষণা করে। ঘোষণায় সংস্থাটি বলেছে, ‘চীনে কী হচ্ছে সেটার জন্য এই ঘোষণা দেওয়া হয়নি, বরং অন্যান্য দেশে যা ঘটছে সেটাই এই ঘোষণার মূল কারণ। উদ্বেগ রয়েছে যে, এই ভাইরাস দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০টি দেশে পৌঁছে গেছে করোনাভাইরাস। চীনসহ বিশ্বব্যাপী এ ভাইরাসে মারা গেছেন ৩ হাজার ২০৩ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৯৩ হাজার ১৩১ জন এবং চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৫০ হাজার ৭৯৫ জন। চীনের পর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। ইতালিতে ৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৫০২ জন এবং চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৬০ জন। ইরানে মারা গেছেন ৭৭ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩৩৬ জন এবং চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৯১ জন। দক্ষিণ কোরিয়ায় মারা গেছেন ৩৩ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৩২৮ জন এবং চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৪১ জন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯ জন এবং ফ্রান্সে চারজনে পৌঁছেছে।

ইতালিতে এক বাংলাদেশি আক্রান্ত : ইতালিতে প্রথমবারের মতো এক বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। এ নিয়ে তিন দেশে মোট ছয়জন বাংলাদেশির এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেল, যাদের মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ ব্যাপারে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এটা আমাদের জন্য একটি দুঃসংবাদ যে, ইতালিতে একজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি অসুস্থ, কিন্তু মারাত্মক নন। তিনি বাসাতেই আছেন, বাসায় রেখেই তার চিকিৎসা করা হচ্ছে।

এর আগে সিঙ্গাপুরে পাঁচ প্রবাসী বাংলাদেশি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেওয়া দুজন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন বলে আইইডিসিআর থেকে জানানো হয়। তবে চীনে থাকা বাংলাদেশি বা বাংলাদেশে কারও মধ্যে এ পর্যন্ত নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়নি।

হট স্পট ৪ দেশের অন অ্যারাইভাল ভিসা স্থগিত : আইইডিসিআরের পরিচালক জানান, রোগটির বিস্তার রোধে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ইরান, ইতালি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা সুবিধা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। ফলে কেউ আসতে চাইলে তাদের আগেই নিয়মমাফিক ভিসার আবেদন করতে হবে। আমাদের দূতাবাস থেকে তাদের ভিসা নিয়ে আসতে হবে। ভিসা নেওয়ার সময় তাদের যে করোনাভাইরাস নেই বা কোয়ারেন্টিন পার করেছেন এমন সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে।

আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, প্রতিদিনই উদ্বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও জাপানকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তিনি বলেন, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে করোনাভাইরাস বাইরে বেরিয়ে গেলে দুই থেকে সাত ঘণ্টা বেঁচে থাকে। সেদিক থেকে সীমান্ত দিয়ে আসা পণ্যের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই।

তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এমন কোনো দেশে আপাতত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া না যেতে এবং সেসব দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে না আসার আহ্বান জানান অধ্যাপক ফ্লোরা। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে কোনো তথ্য সরকার গোপন করছে না। রোগী বা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হবে।

কুয়েতে যেতে সনদ লাগবে বাংলাদেশিদের : করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টায় বাংলাদেশসহ ১০ দেশের নাগরিকদের কুয়েত প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটির সরকার। কুয়েতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষ গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই ১০ দেশের নাগরিকরা কুয়েত দূতাবাসের দেওয়া সনদ দেখাতে পারলে, তবেই তাদের সে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই সনদে লেখা থাকবে ওই যাত্রী করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত। এই সিদ্ধান্ত আগামী ৮ মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিসর, সিরিয়া, আজারবাইজান, তুরস্ক, জর্জিয়া ও লেবাননের নাগরিকদের ওপর এই কড়াকড়ি কার্যকর হবে।

আইইডিসিআর জানায়, মধ্যপ্রাচের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের পর কুয়েতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ জনে।

ঝুঁকির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরাও : বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের শতভাগ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন দেশের বিশেষজ্ঞরাও। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) পরামর্শক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির কথা হু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) বলে দিয়েছে। সে ঝুঁকি আমাদের জন্যও। মূলত দুই কারণে এখানে ঝুঁকি বেশিÑ এক. রোগী শনাক্ত করতে আর্লি ডায়াগনোসিস ও দুই. আক্রান্তদের চিকিৎসায় হাসপাতাল তৈরি করা। এই দুই ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। এ দুটি ঠিকমতো করতে পারলে, করোনাভাইরাস মোকাবিলা সম্ভব।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে শতভাগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, যেকোনো সময় যে কোনো দেশে সংক্রমণ হতে পারে। এ ঝুঁকি আমাদের জন্য শতভাগ। সংক্রমণের সব উপাদানই এখানে রয়েছে। রোগটি শনাক্ত করা ও আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট এবং হাসপাতালকে সংক্রমণমুক্ত রাখাই আমাদের মূল ঝুঁকি। আমাদের হাসপাতালগুলোর ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়। হাসপাতাল থেকেই ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এই দুই বিশেষজ্ঞ জানান, করোনাভাইরাস ঠেকাতে হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে। আইসিইউ লাগবে। আইসোলেট করার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয় সুস্থ ব্যক্তিদের। যারা আক্রান্ত তাদের আইসোলেট করে রাখতে হয়। আমাদের এখানে আইসোলেশন ব্যবস্থা কম।

সতর্ক বাংলাদেশ : আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশে সব ধরনের সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিন স্তরে কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জেলা কমিটির জন্য জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রতিটি কমিটিতেই আছেন স্ব স্ব জেলার সিভিল সার্জন। দেশের হোটেলগুলোকে করোনা নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে এবং তাদের করণীয় কী সেগুলো জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে (আইইডিসিআর) করোনা ইস্যুতে নিজে থেকে এসে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন ৪ জন। গতকালের ৬ জনের নমুনা সংগ্রহসহ আমরা ১০২ জনের নমুনা সংগ্রহ করে দেখেছি। এখনো আরও ৪ জন আমাদের পর্যবেক্ষণে আছেন। তবে এদের কারও মধ্যেই করোনা সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। সব ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছি। রোগী শনাক্ত হলে তাকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। রোগী শনাক্তে ও পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। [সৌজন্য: দেশ রূপান্তর]

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ